উপেন্দ্রনাথ দাস
এক শহুরে ইঁদুরের সঙ্গে এক গেঁয়ো ইঁদুরের বন্ধুত্ব ছিল। একদিন গেঁয়ো ইঁদুর ভাবলে, ‘অনেক দিন আমার বন্ধুকে দেখি নি। একবার তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে মন্দ হয় না।’ আবার ভাবলে, ‘কিন্তু আমি তো শহরের পথঘাট চিনি নে। যাই বা কী ক’রে। তার চেয়ে বরং এক কাজ করা যাক। তাকেই এখানে আসতে চিঠি লিখে দিই।’ এই ভেবে গেঁয়ো ইঁদুর চিঠি লিখল, ‘বন্ধু, অনেক দিন তোমাকে দেখিনি। আমার চিঠিখানা পেয়েই তুমি চলে আসবে। তোমার নেমন্তন্ন রইল। আসবে আসবে।’
চিঠি লিখেই তার ভাবনা হল, ‘এই যা, এখন এটা পাঠাই কী ক’রে!’ গেঁয়ো ইঁদুর থাকত এক গেরস্তের গোলাবাড়িতে। তার উঠোনের এক কোণে ছিল এক আমলকী গাছ। সেই গাছে থাকত বুলবুলি। তার সঙ্গে ইঁদুরের খুব ভাব। আমলকী-তলায় গিয়ে ইঁদুর ডাকল, “বুলবুল, বুলবুল-ভাই।”
বুলবুলি বললে, “আরে ইঁদুর-দাদা যে, এসো এসো, কী খবর!”
ইঁদুর বললে, “বুলবুল-ভাই, একটা কাজ করে দেবে ভাই? বড্ড মুশকিলে পড়ে গেছি। চিঠিখানা দিয়ে আসবে শহরে?”
বুলবুলি বললে, “নিশ্চয়ই, এক্ষুণি যাচ্ছি। কই চিঠি?”
ইঁদুর চিঠি দিল। বুলবুলি তা ঠোঁটে ক’রে নিয়ে ফুডুৎ ক’রে উড়ে চলে গেল।
শহুরে বন্ধু আসবে। গেঁয়ো ইঁদুর তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শহরের মতো ভালো জিনিস তো আর গ্রামে পাওয়া যায় না। তবু ওরই মধ্যে যেখানে যা ভালো জিনিস পেল ইঁদুর তাই জোগাড় করতে লাগল। দু-তিন রকমের কলাই, হরেক রকমের ডাল, ভুট্টা, দু-চার টুকরো পুরোনো পিঠে, কয়েকটি বাদাম, এমনি কত কী সে সারা রাত্তির ধ’রে জোগাড় করল। পরদিন দুপুর বেলা বুলবুলি ফিরে এল। ইঁদুর বললে, “কী বুলবুল-ভাই, খবর কী?”
বুলবুলি বললে, “দিয়ে এলাম চিঠি। সে আজ রাত্তিরেই আসবে।”
ইঁদুর খুশি হয়ে আর যা যা আয়োজন বাকি ছিল তাই করতে লাগল। রাত আটটা-নটার সময় শহুরে ইঁদুর এসে পৌঁছল। অমনি গেঁয়ো ইঁদুর ব্যস্ত হয়ে “এসো এসো, কত দিন পরে তোমায় দেখলাম” ব’লে তাকে বসতে দিল একখানা সুন্দর কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি। তার পর দুই বন্ধুতে অনেক গল্প হল। গেঁয়ো ইঁদুর বললে, “এবার তোমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করি ভাই। বড্ড রাত হয়ে গেছে।” ব’লে পাত পেতে দিয়ে বন্ধুকে ডাকল, আর যত-কিছু খাবার সংগ্রহ করেছিল সব এনে সাজিয়ে দিল। খাবারের নমুনা দেখেই তো শহুরে ইঁদুরের নাক কুঁচকে উঠল। সে এটা সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। আর মাঝে মাঝে এটা থেকে এক কামড়, ওটা থেকে এক কামড় খেতে লাগল। গেঁয়ো ইঁদুর বারবার বলতে লাগল, “পাড়াগাঁয়ে তোমাদের পাতে দেওয়ার মতো কিছুই পাওয়া যায় না। এ-সব জিনিস তোমাদের ভালো লাগবে না জানি, শহরে তোমরা কত ভালো জিনিস খাও। কিন্তু কী করবে ভাই, বন্ধুর জন্য একদিন একটু কষ্ট করতেই হবে। ও কী! তুমি যে কিছুই খাচ্ছ না হে। সব প’ড়ে রইল যে। না, না, এই পিঠেখানা খেতেই হবে।”
ইচ্ছে না থাকলেও বন্ধুকে খুশি করবার জন্য শহুরে ইঁদুর একখানা ফুলুরি নিয়ে খেতে খেতে বললে, “তা যাই বলো ভাই, তোমরা এই পাড়াগাঁয়ে যে কী ক’রে দিন কাটাও আমি তা ভেবেই পাই নে। এখানে না পাওয়া যায় ভালো খাবার, না আছে থিয়েটার বায়োস্কোপ, না আছে ভালো পথঘাট গাড়িঘোড়া। আইসক্রীম নেই, মালাই বরফ নেই, রেডিও নেই, এমন-কি, গ্রামোফোনও নেই। তোমরা কী ক’রে থাক বলো তো। আমি হলে এক দিনও টিকতে পারতাম না, তা তুমি যাই বলো-না কেন।”
গেঁয়ো ইঁদুর বললে, “যা বলছ মিথ্যে নয়, ভাই। তবে কী জান, আমাদের সয়ে গেছে। আমাদের এখানে থাকতে কষ্ট হয় না।”
শহুরে ইঁদুর বললে, “চলো-না হে আমার সঙ্গে শহরে, দেখবে কত মজা। তোমার আর গাঁয়ে ফিরতে ইচ্ছে করবে না।”
গেঁয়ো ইঁদুরের অনেক দিন থেকেই শহরে যাবার লোভ ছিল। তাই বন্ধুর কথায় সহজেই রাজী হল। ঘরদোর গুছিয়ে পরের দিন সন্ধ্যার সময় দু-বন্ধুতে রওনা হল। তারা যখন পৌঁছল তখন রাত প্রায় একটা। শহুরে ইঁদুর যেখানে থাকে সেটা প্রকাণ্ড প্রাসাদ বললেই হয়। মার্বেল পাথরের মেঝে সব ঝকঝক তকতক করছে, দেওয়ালে কত রঙ-বেরঙের ছবি; কোথাও কোথাও আবার প্রকাণ্ড আয়না। শহুরে ইঁদুর এ-ঘর, ও-ঘর ক’রে দেখাতে লাগল আর বলতে লাগল, “কেমন লাগছে হে?” গেঁয়ো ইঁদুর বললে, “চমৎকার।”
তার পর শহুরে ইঁদুর বন্ধুকে খাবারের ঘরে নিয়ে গিয়ে গদি-আঁটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। গেঁয়ো ইঁদুর দেখলে, টেবিলের উপরে নানা রকমের খাবার পড়ে আছে— সেদিন সন্ধ্যায় একটা ভোজ হয়ে গেছে, তারই সব বাড়তি জিনিস। এত রকমের খাবার গেঁয়ো ইঁদুর কোনো দিন দেখে নি। চপ কাটলেট থেকে আরম্ভ করে আইসক্রীম-সন্দেশ পর্যন্ত কোনো জিনিসই বাদ পড়ে নি।
শহুরে ইঁদুর এক-এক ক’রে বন্ধুর সামনে সব এগিয়ে দিলে। তার পর নিজেও এসে কাছে বসে বললে, “এবার আরম্ভ করো হে।” গেঁয়ো ইঁদুর খাবে কী। এ-সব দেখেই তো তার চক্ষুস্থির। কিন্তু, তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে এমন ভাব দেখাতে লাগল, যেন এ-সব সে অনেকবার খেয়েছে। শহুরে ইঁদুর “এটা খাও” “ওটা খাও” ব’লে বারবার তাকে অনুরোধ করতে লাগল।
তাদের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময় খট্ ক’রে সামনের দরজাটা গেল খুলে। আর, সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারজন লোক সেই ঘরে ঢুকল, তাদের সঙ্গে একটা কুকুর। থিয়েটার দেখে তারা বাড়ি ফিরেছে। তাদের দেখেই তো ইঁদুর দুটি ভয়ে দিল ছুট। কিন্তু, যাবে কোথায়? ধারে কাছে কোনো গর্ত-টর্তও নেই যে ঢুকে পড়বে। এ দিকে ইঁদুর দেখে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ ক’রে গর্জে উঠল। সামনে ছিল একটা কৌচ। ইঁদুর দুটি প্রাণের ভয়ে তার নীচেই ঢুকে পড়ল। ভয়ে তখনো তাদের বুক ঢিপ ঢিপ্ করছে। কুকুরটা এক-একবার গর্জে ওঠে আর ইঁদুর দুটো ভয়ে থরথর ক’রে কাঁপতে থাকে। এমনি ক’রে অনেকক্ষণ কাটল, তারপর লোক ক’টি চলে গেল, আর, সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটাও গেল। ঘরে যখন আর সাড়াশব্দ নেই তখন গেঁয়ো ইঁদুর প্রথমে মুখ বাড়িয়ে দেখল, কেউ কোথাও আছে কি না। দেখল, ঘর একেবারে খালি; তখন সে শহুরে ইঁদুরের কানে কানে বললে, “বন্ধু, এমন ভয়ে ভয়ে প্রাসাদে থেকে রাজভোগ খাওয়ার চেয়ে আমাদের গোলাবাড়িতে নিশ্চিন্ত মনে কলাই আর বাসি পিঠে খাওয়া অনেক ভালো। নমস্কার বন্ধু, তোমার শহরের ভালো নিয়ে তুমি থাকো। আমি গাঁয়ের ইঁদুর, গাঁয়েই ফিরে যাচ্ছি।”


