◾পংকজ পাল
বাংলার প্রকৃতি যেন এক চিরন্তন শিল্পীর ক্যানভাস—যেখানে প্রতিটি ঋতু আসে নিজস্ব রঙ, গন্ধ, ও সুর নিয়ে। তার মধ্যে হেমন্ত এক আলাদা মাধুর্যের নাম। গ্রীষ্মের দহন, বর্ষার সজলতা, শরতের শুভ্রতা শেষে যখন প্রকৃতি একটু শান্ত, একটু ক্লান্ত, তখনই সে পরিধান করে সোনালি শাড়ি—এ হেমন্তের সাজ। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে বাংলার মাঠ-ঘাট, আকাশ-বাতাস, নদী ও মানুষের মুখে ফুটে ওঠে এক অপরূপ উজ্জ্বলতা।
হেমন্তের সকাল যেন শিশিরভেজা প্রার্থনার মতো নির্মল। ধানের শিষে বিন্দু বিন্দু শিশির পড়ে থাকে রূপোর দানার মতো, সূর্যের প্রথম আলো তাতে লেগে ঝিলমিল করে ওঠে সোনালি ঝরনার মতো। মাঠজুড়ে পাকা ধানের সুবাসে ম-ম করে ওঠে বাতাস। দূরের বাঁশবনের ভেতর থেকে শোনা যায় রাখালের বাঁশির টান, কুয়াশার পর্দা সরিয়ে প্রকৃতি যেন নিজেই গেয়ে ওঠে নতুন দিনের গান।
এই সময়েই বাংলার গ্রামে শুরু হয় ফসল কাটার উৎসব—নবান্ন। নতুন ধান, নতুন অন্ন, নতুন আশা। কৃষকের ঘরে ঘরে ধান গুচ্ছে, উঠানে শুকায় সোনালি শস্য। চুলোর ধোঁয়ায় ভেসে বেড়ায় পিঠা-পুলির গন্ধ, মুখে হাসি কৃষাণ-কৃষাণির। যেন প্রতিটি ঘরে প্রতিধ্বনিত হয় সুফিয়া কামালের কবিতা—
> “এই তো হেমন্ত দিন, দিল নব ফসল সম্ভার,
অঙ্গনে অঙ্গনে ভরি,
রিক্তের অঞ্চল ভরি হাসি ভরি, ক্ষুধার্তের মুখে
ভবিষ্যৎ সুখের আশা ভরি দিল কৃষকের বুকে।”
শরতের শুভ্র কাশফুলের পরে হেমন্ত প্রকৃতিতে আনে এক মিষ্টি পরিপূর্ণতা। আকাশে তখন আর মেঘ নেই, সূর্য হাসে মৃদু তাপে, বিকেলে ছায়া দীর্ঘ হয় নরম রোদে। সন্ধ্যার আকাশে ফুটে ওঠে ঝিকিমিকি তারা, রাতের নীলে ভেসে আসে হালকা কুয়াশা। এমন সময়েই ফোটে শিউলি, গন্ধরাজ, মল্লিকা, কামিনী—তাদের সুবাসে ভরে ওঠে গ্রামের পথঘাট।

বাংলা সাহিত্যের মহাকবিরা এই হেমন্তের সৌন্দর্যকে ধরেছেন ভিন্ন ভিন্ন রঙে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্তের দীপালিকার আলোয় দেখেছেন আলোকিত জীবনের গান—
> “হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে,
ঘরে ঘরে ডাক পাঠাল—‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’”
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “অঘ্রাণের সওগাত” কবিতায় হেমন্তের আগমনী বার্তা ও ধরণির রূপ তুলে ধরেছেন চিত্রের মতো—
> “চাঁদের প্রদীপ জ্বালাইয়া নিশি জাগিছে একা নিশিথ,
নতুনের পথ চেয়ে চেয়ে হলো হরিত পাতারা পীত।”
তাঁরই অন্য কবিতায় তিনি হেমন্তকে দেখেছেন স্রষ্টার কৃষকের রূপে আবির্ভাব—
> “হেথা খেতভরা ধান নিয়ে আসে অঘ্রাণ,
হেথা প্রাণে ফোটে ফুল, হেথা ফলে ফোটে প্রাণ,
ওরে রাখাল সাজিয়া হেথা আসে ভগবান।”
আল মাহমুদ হেমন্তকে দেখেছেন প্রেম, কামনা ও জীবনের পরিপূর্ণতার প্রতীক হিসেবে। তাঁর “অঘ্রাণ” কবিতায় তিনি লিখেছেন—
> “আজ এই হেমন্তের জলদ বাতাসে
আমার হৃদয় মন মানষীর গন্ধে ভরে গেছে,
রমণীর প্রেম আর লবণ সৌরভে
আমার অহংবোধ বসায় মর্চের দাগ।”
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন হেমন্তে শুনেছেন কৃষকের গান, দেখেছেন সোনালি মাঠে জীবনের উচ্ছ্বাস—
> “আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।”
এইসব কবিতায় যেমন ফুটে ওঠে হেমন্তের চিত্র, তেমনি হেমন্তের রূপে ধরা দেয় বাংলার আত্মা। কুয়াশায় মোড়া সকাল, রৌদ্রস্নাত দুপুর, সোনালি ধানের গন্ধে ভরা সন্ধ্যা—সবকিছুই যেন মিলেমিশে তৈরি করে এক স্বপ্নিল সিম্ফনি।
হেমন্ত কেবল কৃষকের ঘরে ফসল আনে না, সে মানুষকে শেখায় প্রাপ্তির আনন্দ আর ধৈর্যের শিক্ষা। বছরের ক্লান্তি শেষে এই ঋতু প্রকৃতি ও মানুষ দু’জনকেই করে শান্ত ও প্রফুল্ল।
অতএব বলা যায়—
হেমন্ত কেবল ঋতু নয়,
সে বাংলার হৃদয়ের হাসি,
বাংলার মাটির গন্ধ,
আর কবির কলমে লেখা এক চিরন্তন প্রেমগাথা।


