বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মের মধ্যে “আরণ্যক” (১৯৩৯) এক স্বতন্ত্র ও মহিমান্বিত সৃষ্টি। এটি নিছক একটি উপন্যাস নয়, বরং লেখকের গভীর জীবনদর্শন, প্রকৃতির প্রতি অপরিসীম মমতা এবং সভ্যতার আগ্রাসনে বিপন্ন অরণ্য ও তার আদিম অধিবাসীদের জন্য এক মর্মস্পর্শী এলিজি।
পটভূমি ও কথকের চরিত্র:
“আরণ্যক”-এর প্রেক্ষাপট বিহারের পূর্ণিয়া, ভাগলপুর ও মুঙ্গের জেলার অরণ্যভূমি, যা স্থানীয় ভাষায় ‘লবটুলিয়া বইহার’ বা ‘নাড়া বইহার’ নামে পরিচিত। উপন্যাসের কথক সত্যচরণ, কলকাতা থেকে আগত এক যুবক, যিনি অর্থের প্রয়োজনে এই বিশাল অরণ্য-সম্পদের ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর কাজ হলো জঙ্গলমহাল ইজারাদারদের কাছে বিলি করে বন কেটে বসতি স্থাপন ও কৃষিক্ষেত্রের প্রসার ঘটানো। আপাতদৃষ্টিতে এই কাজটি প্রকৃতির বিনাশের সঙ্গে জড়িত হলেও, সত্যচরণের সংবেদনশীল মন ধীরে ধীরে অরণ্যের রূপে, তার রহস্যময়তায় এবং তার সরল মানুষগুলোর জীবনে গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়।
প্রকৃতির চিত্রায়ণ:
“আরণ্যক”-এর প্রাণ হলো এর প্রকৃতি। বিভূতিভূষণ অসামান্য দক্ষতায় অরণ্যের প্রতিটি ঋতু, প্রতিটি মুহূর্তকে জীবন্ত করে তুলেছেন। তাঁর বর্ণনায় ফুল, পাখি, লতাপাতা, নক্ষত্রখচিত আকাশ, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রান্তর, বর্ষার সজল মেঘ, শীতের রুক্ষতা – সবকিছুই পাঠকের মনশ্চক্ষে মূর্ত হয়ে ওঠে। তিনি শুধু প্রকৃতির বাহ্যিক রূপ বর্ণনা করেননি, বরং তার অন্তরাত্মার স্পন্দন অনুভব করেছেন। মহালিখারূপের পাহাড়, সরস্বতী কুণ্ডী, ভানুমতীর কুঁড়েঘর, দিগন্তবিস্তৃত কাশবন – এগুলি নিছক স্থান নয়, বরং প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন মেজাজ ও সত্তার প্রতিচ্ছবি। লেখকের গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং কাব্যিক ভাষা প্রকৃতিকে এক স্বতন্ত্র চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক:
উপন্যাসে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক এক জটিল অথচ অবিচ্ছেদ্য রূপে চিত্রিত হয়েছে। একদিকে রয়েছে সত্যচরণের মতো শহুরে মানুষ, যে প্রথমে প্রকৃতির বিশালতা ও আদিমতায় কিছুটা ভীত ও বিচ্ছিন্ন বোধ করে, কিন্তু ধীরে ধীরে তার নিবিড় সান্নিধ্যে এসে আত্মিক শান্তি খুঁজে পায়। অন্যদিকে রয়েছে অরণ্যের সন্তানতুল্য মানুষেরা – রাজু পাঁড়ে, ধাতুরিয়া, মটুকনাথ, যুগলপ্রসাদ, ভানুমতী, কুন্তা, মঞ্চী প্রমুখ। এদের জীবনযাত্রা, বিশ্বাস, সংস্কার – সবকিছুই অরণ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তারা প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতি তাদের আশ্রয় ও জীবিকা। তাদের সরলতা, সারল্য এবং প্রকৃতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা সভ্য সমাজের জটিলতা ও কৃত্রিমতার সম্পূর্ণ বিপরীত।
সভ্যতার আগ্রাসন ও বিষণ্ণতার সুর:
“আরণ্যক”-এর অন্যতম প্রধান সুর হলো সভ্যতার আগ্রাসনে প্রকৃতির বিনাশ এবং তার ফলস্বরূপ এক গভীর বিষণ্ণতা। সত্যচরণের হাত ধরেই অরণ্যভূমি ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে জনবসতিতে পরিণত হয়। যে প্রকৃতি তাকে মুগ্ধ করেছিল, আশ্রয় দিয়েছিল, সেই প্রকৃতিকেই ধ্বংস করার কাজে সে নিযুক্ত। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব সত্যচরণকে পীড়িত করে। উপন্যাসের শেষে যখন বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমি ফসলের মাঠে পরিণত হয়, তখন লেখকের কণ্ঠেও ঝরে পড়ে এক অব্যক্ত বেদনা। অরণ্যের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় তার আদিম অধিবাসী, তাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারা। এই ক্ষতি অপূরণীয়, যা মানব সমাজকে প্রকৃতির কাছ থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেয়।
দার্শনিক ব্যঞ্জনা:
“আরণ্যক” শুধুমাত্র প্রকৃতির রূপ বর্ণনা বা পরিবেশ সচেতনতার বার্তা নয়, এর গভীরে রয়েছে এক গভীর জীবনদর্শন। বিভূতিভূষণ দেখিয়েছেন যে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে এলে মানুষের আত্মা পরিশুদ্ধ হয়, জীবনের বৃহত্তর অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। অরণ্যের নির্জনতা, বিশালতা ও আদিমতা মানুষকে তুচ্ছতা ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি দেয়। সত্যচরণ এই অরণ্য জীবনে এসে যে মানসিক শান্তি ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধি লাভ করেন, তা শহুরে জীবনে বিরল। লেখকের ঈশ্বরভাবনাও এখানে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের মধ্যে তিনি খুঁজে পান এক গভীর আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা।
চরিত্রচিত্রণ:
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সত্যচরণ ছাড়াও পার্শ্বচরিত্রগুলিও অত্যন্ত জীবন্ত ও গুরুত্বপূর্ণ। সরল বিশ্বাসী রাজু পাঁড়ে, বিদূষী ও রহস্যময়ী ভানুমতী, কবি যুগলপ্রসাদ, শিকারী ধাতুরিয়া, কুসংস্কারাচ্ছন্ন আদিবাসী সমাজ – প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। এই চরিত্রগুলির মাধ্যমে লেখক তৎকালীন অরণ্যচারী মানুষের জীবনযাত্রার এক বিশ্বস্ত চিত্র এঁকেছেন। তাদের দুঃখ-সুখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভয়-বিশ্বাস সবকিছুই উপন্যাসের কাহিনীকে সমৃদ্ধ করেছে।
ভাষা ও শৈলী:
বিভূতিভূষণের ভাষা কাব্যিক, চিত্ররূপময় এবং অত্যন্ত প্রাঞ্জল। তাঁর বর্ণনাভঙ্গি পাঠককে সহজেই অরণ্যের গভীরে নিয়ে যায়। ছোট ছোট ঘটনা, খণ্ড খণ্ড স্মৃতির সমন্বয়ে গঠিত এই উপন্যাসের গঠনশৈলী অনেকটা ডায়েরির মতো, যা সত্যচরণের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিশ্বস্ত দলিল হয়ে উঠেছে। এই শৈলী পাঠককে কথকের আরও নিকটবর্তী করে তোলে।
উপসংহার:
“আরণ্যক” বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী সৃষ্টি। এটি একইসঙ্গে প্রকৃতির প্রতি লেখকের গভীর ভালোবাসা, সভ্যতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ এবং মানবাত্মার চিরন্তন শান্তির অন্বেষণের দলিল। আজকের পরিবেশ সচেতনতার যুগে দাঁড়িয়ে “আরণ্যক”-এর প্রাসঙ্গিকতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উপন্যাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতি শুধু আমাদের ভোগ্যবস্তু নয়, বরং আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রকৃতির বিনাশ আসলে মানব সভ্যতারই সংকট ডেকে আনে। তাই “আরণ্যক” শুধু একটি উপন্যাস নয়, এটি একটি জীবনবোধ, একটি দর্শন, যা পাঠককে বারবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে অনুপ্রাণিত করে।


