আকস্মিক!
নবগঙ্গার ধারে, পঞ্চবটীর গা বাইছে পিঁপি ও পিঁপে! টানের সময়ে বানের দিনগুলোর জন্যে খাবার সংগ্রহের তাগিদে- পিলপিলিয়ে, অশ্বত্থ হতে বট, বট হতে নিম- হরতকী- আমলকি কিংবা তুলসীগাছে!
চৈত্র সংক্রান্তির আমেজ পুরো গ্রামেই। প্রতি ঘরেই কাকভোর হতে ঝাড়-মোছ্ চলছে। কেউ কেউ ঠাকুর পূজোর বাসন, তেঁতুল, বালি ও মলিন পোশাকাদি নিয়ে এসে উঠেছে ঘাটলায়! তেঁতুল কোয়া ও বালি দিয়ে কাসার বাসন মেজে, পোশাক ধুয়ে- স্নান শেষে ঘাট হতে কিছুটা মাটি হাতে করে বাড়ি ফিরছে, সংক্রান্তির দিনে তুলসীতলা আর দুয়ার লেপার জন্যে! কথিত আছে- এই মাটি অশুভ শক্তিনাশক। ‘অশুভ শক্তি নাশ করার উদ্যোগ!’- খারাপ কী! ষোল পদের শাকের খোঁজে, নয় কিংবা নব্বইয়ের কোঠার অনেকেই ঘাটে মাঠে! কেউ কেউ ব্যস্ত নৈবদ্য সাজাতে! থালায় থালায় অালো চাল, কলা, বাতাসা, সন্দেশ, ফল- পাকড়ের মহা অাড়ম্বর! প্রথম নৈবেদ্য মেঘলা নিয়ে এলো। ওর সাথে সাথে শাওন- ভোগরাগের সামগ্রী, ফুলের ঝাঁপিসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে। ঠাকুর মশাই পূজো করছেন! সমস্ত দিক যেন আবাহন গীতি- ধূপ- দীপ-শাঁখ-ঘণ্টার শব্দে বিমোহিত!
পিঁপি ও পিঁপের কান নেই- পিঁপড়ে তো তাই! কিন্তু এরা ‘সেন্সিং ভাইব্রেশন’ দিয়েই- পরিবেশটা যে উৎসবমুখর, তা বুঝে ফেলে ওরা দারুণ খুশি হয়! কারণ?- সন্দেশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশগুলো ওদের খুব প্রিয়! পিঁপে খাদ্য সরবরাহের জন্যে সব্বাইকে খবর দেয়! এরপর কিছুটা সময় একটা বুড়িয়ে হলদে হওয়া অশ্বত্থপত্রের উপর বসে থাকে। চৈতী হাওয়া বয়!- টুপ করে পাতা সহ দুজনাই পড়ে যায় বেদীতে! ব্যথা পায় নি, বরং একটু শূন্যেও ভাসা হল! বাস্তবতার নিরিখে মহাকাল চললেও কখনও কখনও শূন্যে ভাসাও জরুরি, নয় কি?
পূজো শেষে পূজারিণীদের প্রস্থান- বিশ্বনাথে পা হতে গৃহনাথে পায়ে? এও কী সম্ভব! সে যুগ কী আছে! পূজারিণীরা অনুশাসনের সাথে সাথে শাসনও শিখে গেছে! এতক্ষণ বিশ্বসংসার- চালকের স্তুতির সাথে প্রার্থনা উত্থাপন করেছে; এখন হয়ত স্বসংসার- চালকের উপর রাগ- অভিমান বা আদেশ জারি করছে, চৌকাঠে ঢুকতে না ঢুকতেই!
মেঘলা ও শাওনের রসায়নও এরমটাই! শাওনের ঠাকুর ভক্তি একটু কম, মেঘলার ভক্তির মাত্রাটা একটু বেশিই, এভাবেই কম- বেশি করেই বেশ যায় উৎসব-তিথিগুলো! সহধর্মিণীর মন রক্ষার্থে উপাসনা করতে পিছু পিছু যায় অার কি! শাওনের ব্যাপারে বলা যায়- সে ঈশ্বর অপেক্ষা ব্যক্তিগত ঈশ্বরীর মনই বেশি রেখে চলে- হয়ত চলতে পছন্দ করে। শাওন ঝোপঝাড় কম পছন্দ করে, তার পছন্দ বিলাসবহুল- নানান রকমের মার্বেলে মোড়া রং- বেরঙের অত্যাধুনিক স্থাপত্য, যাতে প্রযুক্তিরও ছাপ থাকবে- সবুজায়ন না হলেও তার সমস্যা নেই! পঞ্চবটী গাছগুলো কেটে ঐ জায়গাটায় একটা রঙিন জলের ফোয়ারা গড়ার তাল করছে সে, মেঘলাকে এখনো বলা হয় নি, বললে নাকোচ করে দেবে- এই আশঙ্কায়। এই গৃহে প্রবেশের পর থেকেই মেঘলা ঐ পঞ্চবটী তলায় রোজ সকালে জল-ফল- মিষ্টি দিয়ে পূজো দেয়! প্রায় অর্ধযুগ! ঐ গাছগুলো পাতা- লতা- ছাল- শিকরের প্রতিটির গঠন যেন মেঘলার মনে প্রথমে অাঁকা, পরে এসবের জন্ম! এক্কেবারে ‘মনসিজ’ যাকে বলে! অপরপক্ষে এইগাছের প্রতিটি পোকামাকড়েরও এটা সেন্স করতে অসুবিধা হয় না যে, মেঘলা ওদের জন্যে অন্নপূর্ণা!
গাঙে পানা ফুলের সমাহার! মনে হচ্ছে সবুজাভ আকাশে হালকা বেগুনি আভাময় তারারা ডেব ডেব নীলে-হলুদে মেশানো চোখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে! বাতাসে এদিক ওদিক ঝোঁকে, পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে পানাফুলের আকর্ষণ বল আছে কি না- তার হিসেব নিউটন করুক, এর উপর প্রবল আকর্ষণ বল মেঘলার রয়েছে- এটুকুই জানান দিলাম! তার মার্বেলের মতন স্বচ্ছ চোখেও এই বেগুনি আভাময় বস্তুগুলো আলো ছড়াচ্ছে, নির্দ্বিধায়- নিশ্চিন্তে! যাতে করে এর চোখজোড়া মনে হচ্ছে জ্যোৎস্নাশোভিত জীবন্ত ‘তাজ’! ঈষান কোণে মেঘ জমেছিল সকালে! সেই আষাঢ়ের ঢলে পুঁটির ঝাঁকের লাল শাড়ি পরে জলনৃত্য আর থামছেই না! পিঁপি, পিঁপে ও এদের দলবল বট- অশ্বত্থের পাতাকে ছাউনি করে অাকাশ হতে ধারাপাত দেখছে। সুন্দর শব্দে বৃষ্টি গাইছে, ব্যাঙেরাও লাফ ফাল দিয়ে বর্ষাযাপন করেই যাচ্ছে। দিনগুলো এভাবেই যাচ্ছিল পিঁপি- পিঁপেদের। কথায় বলে,” বসে খেলে রাজার গোলাও ফুরোয়!” এ তো পিঁপড়ের মজুদ, ফুরোনোরই কথা। ফুরোলোও! খাবারের টান পড়তেই দলের সদস্যদের মধ্যকার টান কমে আসে। যে যার মতোন খাবার টুকটাক করে জোটায়, খায়, জমায়। অন্যদের কী জুটলো তা জানায় সুযোগ ও ইচ্ছে দুই ই কমে যায়।
মেঘের দিনে মেঘলার ডাক আসে বাপের বাড়ি থেকে, অনুমতিপূর্বক সে দিন পনেরোর জন্যে নাইওরে যায়। সব মেয়েরই বিয়ের পর প্রথম প্রথম বাপের বাড়ি যাবার জন্যে, বাবা- মার জন্যে মন কেমন করে, বিয়ের কয়েক বছর পরের চিত্র উল্টোটা! নিজের ভরা সংসার, ঘর, দুয়ার, তুলসী ভিটে, পঞ্চবটীর থান-সবটার চিন্তা ই চেপে বসে বাপের বাড়ি যাবার পথে! একেই বলে মায়া! পৃথিবীতে মোহ কেটে যায়, কাটানোও যায়, কিন্তু এই মহামায়ার প্রভাব হতে কে মুক্ত হতে পেরেছে! এর কিছুদিনের মধ্যেই কিছু লোকজন এসে পঞ্চবটীর ডাল পালা কাটতে শুরু করে! পিঁপি- পিঁপেরা বুঝতে পারে বৃক্ষদেবের ধ্বংস যজ্ঞ শুধু হয়ে গেছে, পূজারিণীর আপাত অনুপস্থিতিতেই! সকল ধ্বংসই কি সৃষ্টির ন্যায় আকস্মিক? হবে হয়ত!


