যে বৃষ্টিতে কেউ আসে না ফিরে
১.
আবীরের দিন শেষ হয় সময়মতো, কিন্তু তার রাত শেষ হয় না কোনো নির্দিষ্ট ঘড়িতে। অফিসের ডিউটি শেষে, সে এখন ঢাকার ধানমন্ডিতে একা থাকে। এক কাপ ব্ল্যাক কফি, খোলা জানালা আর নিঃসঙ্গ আলো তার প্রতিদিনের সঙ্গী।
আজ ফোনটা যেন একটু বেশিই কাঁপছে। স্ক্রিনে যে নামটা জ্বলে উঠেছে, সেটা দেখা না দেখার মাঝখানে দুলে ওঠে—”বৃষ্টি কলিং…”
আবীর বিরক্ত হয় না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
“এতদিন পরে?”
রিসিভ করে।
— “হ্যালো?”
— “…আমি… আমি একটু সময় চাই।”
— “তুমি এখন সময় খুঁজছো? একসময় তো সময়টাই ছিলো না আমার জন্য।”
ওপাশে নিঃশব্দ কান্নার মতো শ্বাস।
২.
ফ্ল্যাশব্যাকে পুরনো স্মৃতি ৷ তিন বছর আগের এক সন্ধ্যায়, একটা ঝরাপাতা তার কোলে এসে পড়েছিল। তখন বেকার আবীর— ভালোবাসার দাবিতে পা ফেলেছিলো অনেক নরম মাটিতে।
বৃষ্টি বলেছিল—
— “ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু তোমার পাশে দাঁড়াতে ভয় হয়। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন… আমাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘ও করে কী?’”
— “তাহলে পালিয়ে চলো বৃষ্টি। আমার কিছু নেই, কিন্তু আমি আছি।”
— “না আবীর, আমার সাহস নেই। আমি আমার বাবা-মার মৃত্যুচিঠি হতে পারবো না।”
সেদিন বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে, আবীর দেখেছিলো বৃষ্টির গাড়ি ছুটে যাচ্ছে।
সে বুঝেছিলো, প্রেম অনেক সময় ভালোবাসার চেয়ে সমাজের ওজনেই ভেঙে পড়ে।
৩.
বৃষ্টি আজ বলছে—
— “তুমি জানো না আবীর, আমি কী সহ্য করছি!
সে আমার ওপর হাত তোলে, মা-বাবা থেকে টাকা আনতে বলে। আমার সব কিছু যেন জোর করে কেউ নিয়ে নিচ্ছে। সে তো নেশা করে ৷ শুধু তোমার মুখটা মনে পড়ে— শান্তির মত।”
আবীর শুনে যায়, চুপ করে। তার কণ্ঠে এক নরম কিন্তু পরিণত স্বর—
— “তুমি তখন সমাজের চোখে নিরাপদ থাকতে চেয়েছিলে। এখন ভালোবাসার নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছো?”
বৃষ্টি কাঁদে,
— “আমি সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম। হয়তো তোমাকে ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু সময়ের চাপে হেরে গিয়েছিলাম।”
— “ভালোবাসা কি হেরে যেতে পারে বৃষ্টি?”
— “হয়তো তখন আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তোমার জীবনের সবচেয়ে অসহায় সময়ে আমি ছিলাম সবচেয়ে বাস্তববাদী।”
৪.
আবীর এখন একজন ক্লাস ওয়ান অফিসার ৷ কিন্তু রাত হলে তার ঘর এখনও নিঃসঙ্গ ৷ ফেসবুক স্ক্রল করে কতটুকু সময় কাটানো যায় ? মাঝে মাঝে রিয়া হোয়াটসএপে কল দেয় ৷ খোঁজ খবর নেয় ৷ আজও রিয়া কল দিয়েছে ৷ তার সহকর্মী ও স্নেহের মানুষ, যার সাথে সম্পর্কের সূক্ষ্ম বন্ধন তৈরি হচ্ছে।
রিয়া একদিন বলেছিল—
— “তুমি কি এখনও তার কথা ভাবো?”
আবীর বলেছিল—
— “ভালোবাসা ছেড়ে যায় না, শুধু রঙ বদলায়।”
রিয়া কিছু বলে না। শুধু তার হোয়াটসএপে লিখে যায়—”প্রেমে দ্বিতীয়বার ফিরে আসা মানেই প্রথম ভুল মেনে নেওয়া নয়, বরং ভুলটাকেই সত্যি করে ফেলা।”
৫.
বৃষ্টি আজ বলে—
— “আমি জানি তুমি বদলে গেছো। আমার পাশে দাঁড়ানোর শক্তি এখন তোমার আছে। শুধু একটা সুযোগ দাও—আমাকে মানুষটা হতে দাও, যেটা আমি হতে পারিনি।”
আবীর একদৃষ্টে চেয়ে থাকে জানালার দিকে।
ঝিরঝির বৃষ্টি। একটা পাখি উড়ছে। তারপর ধীরে বলে—
— “তুমি ফিরে আসতে পারো… কথা বলতে পারো…
কিন্তু আমাদের সময়টা আর ফিরবে না, বৃষ্টি। আমি তোমাকে হয়তো এখনও ভালোবাসি—কিন্তু আমি আর সেই মানুষটা নই, যে বৃষ্টির জন্য বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল।”
বৃষ্টির কণ্ঠ ভেঙে পড়ে,
— “তবে আমি এখন কী করবো?”
— “তুমি যেখানেই থাকো, সুখে থাকো। আর আমি… আমি একটা নতুন জীবন গড়েছি, যেটার দরজা তুমি নিজেই একদিন বন্ধ করেছিলে।”
ফোন রেখে দেয় আবীর। তার হোয়াটসএপে রিয়ার লেখা কোটটি চোখে পড়ে আবার—
“দ্বিতীয় ফেরত আসা, প্রথম ছেঁড়া পৃষ্ঠায় লেখা নয়।”
৬.
আবীর জানালার পাশে দাঁড়ালো। আকাশে বৃষ্টির সাথেই অন্ধকার নামছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে ধীরে ধীরে। ব্ল্যাক কফি হাতে নিয়ে দূরে তাকাতেই সে দেখলো বৈদ্যুতিক তারে একটা নিঃসঙ্গ পাখি ৷ এদিকে হোয়াটস এপে রিয়ার ম্যাসেজ ৷ মেসেজ না দেখেই সে কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে রইল ৷
কফির ধোঁয়া মিশে যায় সন্ধ্যার আকাশে।
শেষ।


