বুধবার, নভেম্বর ৫, ২০২৫

অজয় কুমার রায়ের গল্প

মিনিষ্টার

শতাব্দীর সাক্ষী আশি ছুই-ছুই বৃদ্ধা দাদী-মা আমার। ফুটপাতের কংক্রীটে শায়িত। ছেঁড়া কাপড়ে মুখখানা ঢাকা তার । তোমরা পথচারী একটু দয়া কর অবিশ্বাসের যাতনা থেকে তাকে মুক্ত করতে আমাকে সহায়তা দাও। স্বামী-পুত্র যেখানে ঘুমিয়ে সেখান থেকে বহুদূরে এই শহরের কোন এক প্রান্তে, কোন গোরস্থানে তার বিশ্বাসের পাহাড় মাটি চাপা দাও । আমাকে দায় মুক্ত কর । যেন পেতে পারি বেদুইন হয়ে মরুর পথে পথে ঠিকানাহীন পথ চলার অনাবিল আনন্দ। তাকেও ঘুমাতে দাও মাটির স্নিগ্ধ শীতল ঘরে একটু নিঃশ্চিন্ত অবসরে।

তোমরা সিকি, আধুলী ছিটিও না। ঐ ধাতব পদার্থের আঘাতে দাদী-মার নিথর দেহ ব্যথা পাবে ।

তবুও তোমরা শুনছো না। জানি, শুনবেও না। কারণ রাজপথে এই নিক্ষিপ্ত করুণার ত্যাগের অহমিকাতেই তোমাদের প্রশান্তি “ইচ্ছে ছিল না,মোটেও না। কিন্তু দাদী-মার দেহটাকে আঘাত মুক্ত করতে আমাকে বলতেই হলো । লজ্জার আবরণে নিজেকে ঢেকে রেখে আমি তো আর তাকে কষ্ট দিতে পারি না । তাই…

গ্রাম বাংলার এক নিভৃত কোণে দাদী-মার স্বামীর ঘর। এখানে এই ইট-পাথরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে ঘরের বর্ণনা আর নাই বা দিলাম । শুধু এইটুকু বলি সাত বছরের কনে হয়ে এসেছিল সে এক দিনমুজুরের ঘরে ।

বাবা নাবালক থাকতেই দাদাজান মারা গেলেন। ছোট বেলা থেকেই ভাল গায়েন হিসাবে আশে পাশের গাঁয়ে আমার বাবার সুখ্যাতি ছিল। সংসারে মন একটুও ছিল না। দাদী-মা তাকে বাঁধতে চাইলেন । বাঁধন-হারাকে কিছুতেই বাঁধতে পারলো না আমার মা ।

দাদী মা মাঝে মাঝে কাঁদতেন। মাঝে মাঝে তিরস্কার করতেন। ঘোমটার নীচে মায়ের চোখে আষাঢ়ের প্লাবণ ছুটতো, কেউ জানতো না, বুঝতো না। আমার যখন জন্ম হলো- দাদার বসত ভিটেটুকুও শেষ হয়ে গেছে। পরের আশ্রয়ে আমি পৃথিবীর আলো দেখলাম। আমার চোখে আলো জ্বেলে দিয়ে মা নিভে গেলো । ভালই হলো, বাবা নির্বাসনে, মায়ের চোখে চির নিদ্রা। শুধু আমি আর দাদী-মা ৷

গ্রামের এক মোড়লের বাড়ীতে আমরা যখন আশ্রিত তখন আমার স্কুলে যাবার বয়স। দাদীমার ইচ্ছে ছিল মোড়লের ছেলের সাথে আমিও স্কুলে যাই। কিন্তু এই পৃথিবীতে সবার সব ইচ্ছে তো পূরণ হয় না। দাদীমারও হলো না। মোড়লের এক পাল গরু সামলাতেই আমি বেসামাল হয়ে পড়তাম । এমনি সময়ে একাত্তরের এক নীরব সকালে খবর এলো-বাবা খুন হয়েছেন । চৌরাস্তার মোড়ে বটগাছের নীচে তার রক্তাক্ত দেহ । হয়তো রক্তের বন্ধন তাকে হাতছানি দিয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। পরে জেনেছিলাম তার বিরুদ্ধে তথাকথিত দেশদ্রোহিতার অভিযোগ। কি এক আপত্তিকর মুক্তির গান রচনা করে সুরও দিয়ে গণজাগরন সৃষ্টি করছে।

জ্বলন্ত বহ্নিদাহে উত্তপ্ত দাদী-মা আমাকে বুকে জড়িয়ে সমস্ত ক্ষত সান্ত্বনার প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দিতেন। আমি বুঝতাম ।

সময়ের রথে তালে তাল মিলিয়ে পৃথিবী এগিয়ে চলছিল। আমি যখন কৈশোর- যৌবনের সন্ধিস্থলে অবস্থান করছি। শুরু হলো ভোটযুদ্ধ। যুদ্ধের কথা শুনে দাদী-মা আতকে উঠেছিল । আমি তাকে বোঝালাম-এযুদ্ধ সে যুদ্ধ নয়- এটা হলো মন্ত্রী-মিনিষ্টার হবার যুদ্ধ । শীত যায় যায় । বসন্ত আগমন প্রতীক্ষায় । ঘন কুয়াশাছন্ন সকাল। মোড়লবাড়ীর বাইরের উঠানে আমি আর দাদী-মা।

এক দল লোক এদিকেই আসছে। দাদীমার পা ছুঁয়ে কদমবুচি করলো এক ভদ্রলোক। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবী।
দাদীমা-কে জড়িয়ে ধরে বলল-মা। আমি সাদেক, তোমার ছেলে, তোমার দোয়া চাইতে এসেছি।

দাদীমা হতবাক । পুনরায় তার পা ছুঁয়ে সাদেক সাহেব বলল-আমি যদি নির্বাচিত হতে পারি মা, গরীবের কোন দুঃখ কষ্ট থাকবে না। তোমরা আর অনাহারে মরবে না, গৃহহারা হবে না, কাজের অভাবে পরের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে হবে না। আমিও গরীব । তোমাদের দুঃখে প্রাণ কাঁদে । কিন্তু কি করবো? ক্ষমতায় না গেলে তো কাজ করা যায় না।

বিহবলের মত দাঁড়িয়ে রইলো দাদী-মা। মুখ দিয়ে একটি কথাও সরলো না। পুনরায় দাদীমাকে জড়িয়ে ধরে বলল- মা, তুমি দোয়া করলে? আমাকে ভোট দিয়ে-ভোট চেয়ে জয়যুক্ত করে গরীব-দুঃখীর মুখে হাসি ফোটাতে সাহায্য করবে?

পুবের লাল সূর্য্য সাক্ষী রেখে দাদী মা প্রাণ ভরে দোয়া করলেন । ওরা চলে গেল । হাত তুলে দাদী মা খোদার দরবারে প্রার্থনা জানালো, তিনি যেন ওর উপর তাঁর রহমত নাজেল করেন ।

সেদিন সারা রাত দাদীমার ঘুম এলো না। আযানের পর নামাজ সেরে বিছানায় এসে আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল-হ্যা-রে রাজা। সাদেক মন্ত্রী হবে তো? লোকটা বড় ভালরে । গরীবের কথা এমনি করে কেউ বলে না । ওর জন্যে একটু কাজ করিস ভাই ।

আমিও করবো । পাড়ায় আমার কথা কেউ ফেলতে পারবে না । ভোটযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। দাদীমার শ্রম স্বার্থক। খোদার দরবারে তার প্রসারিত হাত ফল দিয়েছে। সাদেক সাহেব পাশ করেছেন ।

মোড়ল বাড়ীর বড় ছেলে ঢাকা থেকে এসে জানাল-তিনি নাকি মন্ত্রীও হয়েছেন। দাদীমার কি আনন্দ। কত তার গর্ব। এতদিনের উৎকণ্ঠিত প্রাণে স্বস্তির নিঃশ্বাস। দাদীমা মাঝে মাঝে বলতো- দেখবি, ও ঠিকই একদিন আসবে। আমার কথা মনে করে না এসেই পারে না। সেদিন ওর কাছে কি চাইবো জানিস রাজা, তোর জন্যে একটা চাকরী । তুই চাকরী করবি। তোকে আর গরুর পাল চড়াতে হবে না। শহর থেকে সাহেব হয়ে ফিরবি । সবাই তাকিয়ে থাকবে। মোড়লের গালমন্দ শুনতে হবে না। তারপর- তারপর একটা ফুলপরী আনবো। ফোকলা গালে তার এমন মায়া জোড়ানো হাসি আমি কোন দিন দেখিনি । একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলো- কিন্তু কিন্তু কারো জন্যে কিছু করে বিনিময় চাওয়াটা বুঝি ঠিক হয় না, তাই না-রে রাজা ……. তা হোক, তবুও তোর জন্য আমি চাইব ।

দাদীমার অফুরন্ত প্রতীক্ষা আর অটল বিশ্বাসে ক্ষয়রোধ করতে না পেরে একদিন দুরন্ত অধৈর্য্যের অশান্ত ঘূর্ণি তাকে ব্যাকুল করে তুললো।

তবুও সান্ত্বনা – ‘হ্যারে মন্ত্রী হওয়া বুঝি খু-উ-ব ঝামেলার কাজ। সারা দিন রাত বুঝি ব্যস্ত থাকতে হয়। ঠিক আছে, আমিই না হয় যাব তার কাছে। মোড়লের ছেলের কাছ থেকে ঠিকানাটা নিয়ে নেব। দাদী-নাতিতে হঠাৎ করে যেয়ে চমক লাগিয়ে দেবো। ও ভীষণ লজ্জা পাবে । লজ্জা আমি ওকে দিবই ।

মন্ত্রী বাড়ীর গেটে নিরাপত্তা ব্যূহ। গেট পাস নিয়ে কত জন যাতায়াত করছে। আমার দাদীমা নিরাপত্তা দায়িত্বে নিয়োজিত প্রহরীদের কত অনুনয় বিনয় করলো। কোন সাড়া মিললো না। ব্যর্থ দাদীমা এক পর্যায়ে বে-পরোয়া হয়ে উঠলো। আমি তাকে কিছুতেই নিরস্ত করতে পারলাম না। ‘ছেলের কাছে মা-য় যাইবো, তার আবার কাগজ কিসের-রে। বলতে বলতে দাদীমা জোর করে ঢুকতে গেল। ধস্তাধস্তি -দাদীমা লুটিয়ে পড়লো হাত-পা ধরে চ্যাঙ-দোলা করে এক পাশে আছরে ফেলে দিল। আমাকে ধমকে বলে দিল, ‘এই ছোঁড়া, এই বুড়ীকে নিয়ে এখান থেকে কেটে পড়’ তা না হলে কিন্তু জেলে ঢুকিয়ে দেব।’

বাঁশীতে ফুঁ পড়লো । মাথার কাছে বসে দাদীমাকে বললাম, মন্ত্রী এখন চলে যাচ্ছে। যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে দাদীমা । তবুও হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা। মন্ত্রীর গাড়ী বেরিয়ে পড়েছে। চীৎকার করে উঠলো দাদীমা ‘সাদেক-সাদেক বাবা আমার একটা কথা – একটা….

গাড়ীর ইঞ্জিনের হুংকারে দাদীমার প্রাণের আকুতি চাপা পড়ে গেল। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

একসময় চোখ মুছে মাটিতে দেহ এলিয়ে দিল। প্রহরীদের দায়িত্ব পালনে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে কয়েকজন পথচারীর সহায়তায় দাদীমাকে এই ফুটপাতের এক কোনায় অনেক কষ্ট করে একটু ঠাঁই করে নিলাম । দাদীমার চেতনার মৃত্যু হয়ে গেছে। শুধু বুক-টা তখনও থেমে থেমে ওঠা-নামা করছে। তারপর তারপর এক সময়…

লেখক পরিচিতি

অজয় কুমার রায়
অজয় কুমার রায়
কবি গল্পকার ও প্রাবন্ধিক অজয় কুমার রায় মানিকগঞ্জ জেলায় ঘিওর উপজেলার নারচি গ্রামে ১৯৪৮ সালের ৫ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-প্রয়াত অক্ষয় কুমার রায়,মাতা-দিভা রায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে ২০০৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা,সাময়িকীতে ও যৌথ গ্রন্থে কবিতা,গল্প,নাটক প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অসংখ্য ফাইলবন্দী লেখা থেকে প্রথম গল্পগ্রস্থ ‘শতাব্দীর ক্ষুধা’ একুশে বইমেলা‘১৫ তে প্রকাশ হয়েছে। পরবর্তী বছর একক কাব্যগ্রন্থ 'রংধনু' প্রকাশিত হয়েছ ৷ তিনি অন্তরঙ্গ সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ৷ তিনি শিল্প সাহিত্য ও মননের অনলাইন মাসিক'পলিমাটি'র উপদেষ্টা সম্পাদক ৷ এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন। বিভিন্ন সংগঠন হতে বহু সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন ।

আরও লেখা

spot_img

সাম্প্রতিক লেখা