মঙ্গলবার, নভেম্বর ৪, ২০২৫

শরৎকাল : সাদা মেঘের ভেলা আর কবিতার দেশ

ভূমিকা

বাংলার প্রকৃতির ঋতুচক্রে শরৎ এক স্বপ্নময় ঋতু। বর্ষার সিক্ততা যখন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যায়, তখন আকাশ জুড়ে নীলিমার মাঝে ভেসে ওঠে সাদা মেঘের পাল, কাশবনে দুলে ওঠে শুভ্র ঢেউ, আর বাতাসে ভেসে আসে শিউলির গন্ধ। কবিদের কাছে শরৎ তাই কেবল ঋতু নয়—এটি সৌন্দর্যের প্রতীক, প্রেমের রূপক, আর জীবনের মরমী অনুভব।

প্রকৃতির শরৎ

শরতের মূল সৌন্দর্য নিহিত আকাশে। নির্মল নীল আকাশে ভেসে থাকা তুলোর মতো মেঘের ভেলা যেন এক জীবন্ত চিত্রকল্প। রবীন্দ্রনাথ একে তুলনা করেছেন প্রাণের ভরপুরতার সঙ্গে—
“আকাশ ভরা সূর্যতারা, বিশ্ব ভরা প্রাণ।”
শরতের এই নীলিমা মানুষকে এনে দেয় প্রশান্তি ও উল্লাস।

শরৎ মানেই কাশফুলের শুভ্রতা। গ্রামবাংলার মাঠঘাট জুড়ে যখন কাশফুলের ঢেউ ওঠে, তখন মনে হয় যেন প্রকৃতি তার নিজস্ব পতাকা উড়িয়ে দিচ্ছে। এই রূপকে কেন্দ্র করেই জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন—
“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে—শরতের শাদা কাশফুলের পাশে।”

ভোরবেলায় শিশিরভেজা ঘাসে পা রেখে হাঁটতে হাঁটতে যে সতেজতার স্বাদ মেলে, সেটি একান্তই শরতের উপহার।

সাহিত্যে শরতের প্রতিফলন

বাংলা সাহিত্যের বড় অংশ জুড়ে শরতের অবিরাম উপস্থিতি।

  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎকে দেখেছেন শান্তি, স্বচ্ছতা আর ভক্তির রূপে। তাঁর কবিতায় শরৎ কখনো সোনার তরী বেয়ে ভাসা, কখনো উৎসবের ছন্দ। “কতই রঙের হাটে কতই সোনার মেলা”— এই সোনার মেলা আসলে শরতের সোনালি ধান ও আলো।
  • জীবনানন্দ দাশ শরতের প্রকৃতিকে রূপ দিয়েছেন অন্তর্মুখী আবেগে। তাঁর কবিতায় শরৎ মানে প্রত্যাবর্তন—শেকড়ে ফেরা।
  • সুভাষ মুখোপাধ্যায় শরতের সহজ সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন এইভাবে—
    “শরৎ এসেছে শিউলির গন্ধে, শাদা মেঘের পালে।”

বাংলার আধুনিক কবিতায়ও শরৎ মানে শিউলি-সুবাস, পূজার আনন্দ আর প্রেমের আবাহন।

উৎসব ও সাংস্কৃতিক দিক

শরৎ মানেই শারদীয় দুর্গোৎসব। প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনেও তখন উৎসবের ঢেউ ওঠে। গ্রামে ধানক্ষেতে ধীরে ধীরে সোনালি রং ছড়িয়ে পড়ে, আর শহরে পূজার আলোকসজ্জা ও আনন্দমেলা শরতের আবহকে দ্বিগুণ করে তোলে। এভাবেই শরৎ প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে একসঙ্গে বেঁধে দেয়।

সাহিত্যিক বিশ্লেষণ

শরৎকাল আসলে বাঙালির কল্পনার এক অনন্ত ক্ষেত্র। এটি আমাদের সাহিত্যকে দিয়েছে কাব্যময়তা, দিয়েছে রূপক। সাদা মেঘ যেমন ভেসে চলে, তেমনি শরৎ মানুষের মনের ভেতর বয়ে আনে নতুন আশা। কবিরা তাই শরত্‌কে দেখেছেন—

  • কারও কাছে প্রেমের দ্যুতি,
  • কারও কাছে প্রকৃতির পবিত্রতা,
  • কারও কাছে মায়ের পূজার রঙিন প্রতিচ্ছবি।

শরৎ একদিকে উৎসবের, অন্যদিকে স্মৃতির; একদিকে বাস্তব, অন্যদিকে কবিতার প্রতীক।

উপসংহার

আজকের ব্যস্ত সময়ে শরৎ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আকাশের দিকে তাকানোও একপ্রকার ধ্যান। সাদা মেঘ, কাশফুল, শিউলির সুবাস—এসবই আমাদের শেখায় প্রকৃতির সরল সৌন্দর্যকে ভালোবাসতে। কবিদের কলমে তাই শরৎ হয়ে ওঠে কেবল ঋতু নয়, এক অবিরাম কবিতা।

লেখক পরিচিতি

পংকজ পাল
পংকজ পাল
তরুণ গল্পকার ও কবির জন্ম ১৫ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলায় ৷ বি.এস.সি (অনার্স), এম.এস.সি ; এল.এল.বি; শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন ৷ তার প্রকাশিত একক গ্রন্থ দুইটি ৷ কাব্যগ্রন্থ-'নিঃসঙ্গতার মেঘমালা' ও গল্পগ্রন্থ-'আকাশের নীল রং' এবং যৌথগ্রন্থ-চল্লিশের বেশি ৷ জেলার উদীচী, প্রগতি লেখক সংঘ, খেলাঘর, প্রথম আলো বন্ধুসভা, উত্তরণসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন ৷ বর্তমানে সম্পাদনা করছেন-'পলিমাটি','অন্তরঙ্গ 'ও 'চিন্ময়ী'৷ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে জেলা পর্যায়ে আয়োজিত ৩১তম বিজ্ঞান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সপ্তাহ ২০০৯-১০ খ্রিস্টাব্দে সিনিয়র গ্রুপে প্রথম স্থান, কবিতা সংসদ সাহিত্য পদক-২০১৪, বাংলাদেশের লেখক-'লেখক ডিরেক্টরি'র অন্তর্ভূক্ত-২০১৪, কাব্য চন্দ্রিকা একাডেমি পদক-২০১৭, লিখিয়ে কাব্য সাহিত্য সম্মাননা-২০১৮, পল্লী কবি জসীমউদ্দীন স্মারক-২০১৮, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি স্মারক ও সম্মাননা-২০২২ পেয়েছেন ৷ মেইল : pankajprenoy@gmail.com/ paulpankaj864@gmail.com

আরও লেখা

spot_img

সাম্প্রতিক লেখা