মঙ্গলবার, নভেম্বর ৪, ২০২৫

রফিকউদ্দিন আহমদ: ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ

পংকজ পাল

ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের পারিল (বর্তমান রফিকনগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুল লতিফ ও মাতা রাফিজা খাতুন দম্পতির পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে রফিক ছিলেন বড় সন্তান। রফিকের দাদার নাম মোঃ মকিম উদ্দিন। রফিক ১৯৪৯ সালে উপজেলার বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পাশ করে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন।

রফিকের বাবা আবদুল লতিফ তখন ঢাকায় মুদ্রণব্যবসার সঙ্গে জড়িয়েছেন নিজেকে। আর রফিকের ভগ্নিপতি মোবারক আলী হাজি ওসমান গনি রোডে শুরু করেছেন বই বাঁধাইয়ের কারখানা। রফিক ইতিমধ্যে দেবেন্দ্র কলেজের পাঠ অসম্পূর্ণ রেখে ভর্তি হয়েছেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার প্রেসের কাজ দেখাশোনা করছেন।

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। সে রাতে রফিক উদ্দিন গিয়েছেন ভগ্নিপতির কারখানায়।শহরজুড়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে —রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আগামীকাল ছাত্ররা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জড়ো হবেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।আর অন্য সবার মতো রফিকের ভগ্নিপতি মোবারক আলী খানও নিশ্চিত বড় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। সংশয়ে, শঙ্কায় মোবারক আলী রফিককে মিছিল-মিটিংয়ে যেতে নিষেধ করলেন। মাঝরাতে রফিক ফিরে গেলেন নিজেদের প্রেসে।রফিক উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি পারিলের মেয়ে রাহেলা খাতুনের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং পরে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে ঠিক করা হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি রফিকের বিয়ের বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও তিনি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রদের মিছিলে সেদিন যোগ দেন। এতো বড় একটা আন্দোলন থেকে কি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন রফিক? বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রয়াসে ১৪৪ ধারা ভাঙলেন। ফাল্গুনের অপরাহ্নে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হওয়ার পর তিনি অবস্থান নিলেন মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাকের সামনের রাস্তায়। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করল, নিক্ষেপ করল টিয়ার গ্যাস, মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করল। তপ্ত, তিক্ত সেই গুলি রফিক উদ্দিন আহমদের মাথার খুলি উড়িযে দেয়, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে তিনিই প্রথম গুলিবিদ্ধ হন। ফলে সিংগাইরের কৃতিসন্তান রফিক উদ্দিন ভাষার জন্য প্রথম শহীদের মর্যাদা লাভ করেন।মেডিকেল হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্বদিকে তার লাশ পড়ে ছিল। ছয় সাত জন আন্দোলনকর্মী তার লাশ এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে রাখেন। তাদের মাঝে ডাঃ মশাররফুর রহমান খান রফিকের গুলিতে ছিটকে পড়া মগজ হাতে করে নিয়ে যান। পাকিস্থান শাসক তাকে শহীদ করেও ক্ষান্ত হয়নি। তাঁর লাশ সেখান থেকে নিয়ে পুলিশ লুকিয়ে রাখে, পরে তার মৃতদেহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যায়। শহীদদের লাশ নিয়ে বড় ধরনের আন্দোলন হতে পারে এই ভয়ে পাকিস্তান সরকার শহীদ রফিকের লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে সেদিন রাত ৩টায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় তড়িঘড়ি করে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে শহীদ রফিককে সমাহিত করা হয়।রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রফিক উদ্দিনের আত্মত্যাগের জন্য ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে। এছাড়া তার গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রফিকনগর করা হয়। সিংগাইর ও মানিকগঞ্জে রয়েছে তাঁর নামে সড়ক। হেমায়েতপুর-সিংগাইরের ধলেশ্বরী নদীর উপর শহীদ রফিক সেতু নির্মিত হয়েছে। এবং গ্রামে তার নামে ‘ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভবনের নাম ‘ভাষাশহীদ রফিক ভবন’ নামকরণ করা হয়।

লেখক পরিচিতি

পংকজ পাল
পংকজ পাল
তরুণ গল্পকার ও কবির জন্ম ১৫ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলায় ৷ বি.এস.সি (অনার্স), এম.এস.সি ; এল.এল.বি; শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন ৷ তার প্রকাশিত একক গ্রন্থ দুইটি ৷ কাব্যগ্রন্থ-'নিঃসঙ্গতার মেঘমালা' ও গল্পগ্রন্থ-'আকাশের নীল রং' এবং যৌথগ্রন্থ-চল্লিশের বেশি ৷ জেলার উদীচী, প্রগতি লেখক সংঘ, খেলাঘর, প্রথম আলো বন্ধুসভা, উত্তরণসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন ৷ বর্তমানে সম্পাদনা করছেন-'পলিমাটি','অন্তরঙ্গ 'ও 'চিন্ময়ী'৷ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে জেলা পর্যায়ে আয়োজিত ৩১তম বিজ্ঞান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সপ্তাহ ২০০৯-১০ খ্রিস্টাব্দে সিনিয়র গ্রুপে প্রথম স্থান, কবিতা সংসদ সাহিত্য পদক-২০১৪, বাংলাদেশের লেখক-'লেখক ডিরেক্টরি'র অন্তর্ভূক্ত-২০১৪, কাব্য চন্দ্রিকা একাডেমি পদক-২০১৭, লিখিয়ে কাব্য সাহিত্য সম্মাননা-২০১৮, পল্লী কবি জসীমউদ্দীন স্মারক-২০১৮, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি স্মারক ও সম্মাননা-২০২২ পেয়েছেন ৷ মেইল : pankajprenoy@gmail.com/ paulpankaj864@gmail.com

আরও লেখা

spot_img

সাম্প্রতিক লেখা