আজ ২৫ জুলাই, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিন। জন্ম ১৯৩৯ সালে। একজন মানুষ কতভাবে একটি জাতিকে আলোকিত করতে পারেন—তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিনি। শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমাজসংস্কারক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সংগঠক—এই প্রতিটি পরিচয়ের বাইরেও তিনি এক অনন্যপ্রাণ, যিনি বিশ্বাস করেন, মানুষ যদি পাঠে ডুবে যায়, তবে সে মানুষ কখনো অন্ধকারে হাঁটে না।
শিকড়ে আলো: কৈশোর থেকে কর্মযাত্রা
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্ম ভারতের কলকাতায়। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার বাংলাদেশে চলে আসে। ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা বিকশিত হতে থাকে। তিনি ঢাকা কলেজ, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষা ও চিন্তাধারার বিকাশে বাংলা সাহিত্যের গভীর ভূমিকা ছিল।
ষাটের দশকে তিনি প্রতিশ্রুতিশীল কবি ও সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তবে সাহিত্যচর্চার সীমিত পরিসর ছাড়িয়ে তিনি মনোনিবেশ করেন বৃহত্তর মানবিক অভিযাত্রায়—মানুষকে পড়ায়, জানায়, ভাবায় এবং জাগায়।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র: পাঠাভ্যাসের বিপ্লব
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি নিঃসন্দেহে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি তাঁর স্বপ্নের প্রতিফলন, যেখানে বই পড়া আর আলোচনার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে তোলা হয় বিবেক, বোধ ও মূল্যবোধের ভিত্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন—“ভালো বই মানুষকে শুধু জ্ঞান দেয় না, তাকে ভালো মানুষ করে।”
‘আলোকিত মানুষ চাই’—এই স্লোগানকে সামনে রেখে তিনি বই হাতে ছুটেছেন নগর থেকে প্রান্তরে, তরুণদের পাঠচক্রে, আলাপনে, যুক্তিতে, স্বপ্নে। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ও পাঠাভ্যাসকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন তিনি।
শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের অবদানে বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে তাঁকে একুশে পদক প্রদান করে। ২০০৪ সালে তিনি পান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি—রোমেন ম্যাগসেসে পুরস্কার, যা এশিয়ার নোবেল হিসেবে খ্যাত। এছাড়াও ২০১২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন প্রবন্ধ সাহিত্যে অবদানের জন্য।
তাঁকে নিয়ে একটি কথা প্রায়শ বলা হয়—“যদি একজন সত্যিকার শিক্ষক সমাজে থাকেন, তবে তার পরিচয় তার ছাত্ররা হয়ে ওঠে।” সায়ীদের হাজার হাজার ছাত্র, যাঁরা আজ বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত, তাঁর চিন্তা ও আদর্শ বহন করে চলেছেন।
কথার যাদুকর
তাঁর ভাষায় আছে অনুপ্রেরণা, তাঁর কণ্ঠে আছে আলোড়ন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে উপস্থাপক হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তাঁর উপস্থাপনায় ছিল জ্ঞানের আলো, দর্শনের দীপ্তি আর আবেগের পরিমিত সংযম। তাঁর বক্তৃতা আজও তরুণদের ঘুম ভাঙানোর ঘন্টা হয়ে ওঠে।
এই দিনে, এই মানুষটিকে
আজ তাঁর জন্মদিনে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সেই মানুষটিকে, যিনি শুধু বই পড়ার কথা বলেননি, বইকে জীবন ও মুক্তির উপায় হিসেবে দেখেছেন। তাঁর কাছে পাঠ্যপুস্তক নয়, জীবনই ছিল বড়ো পাঠশালা। প্রতিটি মানুষের ভেতরেই তিনি খুঁজেছেন একটি আলো, যেটিকে ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজে, রাষ্ট্রে, বিশ্বে।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিনে আমাদের প্রত্যাশা—তিনি যেন সুস্থ থাকেন, শক্ত থাকেন, আর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যান আরো কিছু অমূল্য আলোর পথ।
শেষকথা:
“মানুষকে যদি বদলাতে চাও, তাকে বইয়ের মুখোমুখি বসিয়ে দাও ৷” — আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
তিনি সেই কাজটাই করে গেছেন জীবনের প্রতিটি দিনে।
লেখক: পংকজ পাল
প্রকাশকাল: ২৫ জুলাই
বিষয়: প্রেরণামূলক, জীবনীভিত্তিক প্রবন্ধ


